রাসুলুল্লাহকে (সা.) ‘জঙ্গি’ বললে ইসলাম থেকে খারিজের আশঙ্কা থাকে






সম্প্রতি কতিপয় ওয়ায়েজিন ও ধর্মীয় বক্তা নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন। তারা দাবি করছেন, জঙ্গি শব্দটি ফার্সি জঙ্গ থেকে উৎপন্ন। জঙ্গ অর্থ





যুদ্ধ, সুতরাং জঙ্গি অর্থ যোদ্ধা। রাসুল (সা.) যেহেতু বেশ কিছু যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন, তাই রাসুল (সা.) জঙ্গি ছিলেন। তার সঙ্গী





সাহাবিরাও জঙ্গি ছিলেন। এর সপক্ষে নুরুদ্দিন জঙ্গির নামও উল্লেখ করেন। নুরুদ্দিন জঙ্গিকে জঙ্গি বলার কারণ তিনি নিজেও অনেকগুলো যুদ্ধ করেছেন। রাসুলুল্লাহকে (সা.) ‘জঙ্গি’ বললে ইসলাম থেকে খারিজের আশঙ্কা নুরুদ্দিন জঙ্গি ত্রয়োদশ শতকের বিখ্যাত সলজুক সালতানাতের একজন শাসক। মুসলিম ইতিহাসের বিখ্যাত সমরনায়ক ও বীর সালাহউদ্দিন আইউবি তার অধীনই সেনাপতিত্ব করেছেন। এসব কূটতর্ক থেকেই





তারা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে জঙ্গিবাদ ও মুক্তিযোদ্ধাদের জঙ্গি হিসেবে আখ্যায়িত করার দুঃসাহস দেখিয়েছেন। প্রিয় নবী (সা.) ও তার সাহাবিদের জঙ্গি বলা এবং মুক্তিযোদ্ধাদের জঙ্গি বলা চরম দুঃসাহস বটে। দেশ ও ধর্মের প্রতি সুকৌশলে একপ্রকার বিদ্বেষ প্রকাশই এর লক্ষ্য। শব্দটি নিয়ে যে ধরনের ব্যাখ্যা তারা পেশ করছেন, তা মূলত সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করার নামান্তর। জঙ্গি শব্দটি নিঃসন্দেহে ফার্সি জঙ্গ শব্দ থেকে এসেছে। কিন্তু জঙ্গি অর্থ শুধুই যোদ্ধা নয়। জঙ্গি শব্দটির বিভিন্ন ব্যবহার রয়েছে। উর্দু-বাংলা অভিধান ফরহাঙ্গে জাদীদ-এর ৩০১ পৃষ্ঠায়





জঙ্গি শব্দের বিশ্লেষণ করা হয়েছে এভাবে: জঙ্গি ফা. বি.; যুদ্ধসংক্রান্ত, সমরযোগ্য, সৈনিক, দাঙ্গাবাজ। দেখা যাচ্ছে উর্দু-ফারসি অভিধানে জঙ্গ শব্দটি যুদ্ধ অর্থে ব্যবহৃত হলেও জঙ্গি শব্দের ইতিবাচক-নেতিবাচক দুই অর্থই রয়েছে। বাংলা ভাষায় ফারসি থেকে শব্দটি এসেছে। কিন্তু এটি বাংলায় নেতিবাচক অর্থেই ব্যবহৃত হয়। অভিধান দেখে কোনো একটি ভালো অর্থ পেয়েই সে অর্থে যেখানে-সেখানে ব্যবহার করা যায় না। রাসুলকে (সা.) মুনাফিকরা ‘রাইনা’ বলে সম্বোধন করত। এই শব্দটির দুটি অর্থ ছিল, প্রথম অর্থ হচ্ছে ‘আমাদের দিকে খেয়াল করুন’। দ্বিতীয় অর্থ হচ্ছে ‘আমাদের রাখাল’। সাহাবিরা যখন ‘রাইনা’ বলতেন, তখন প্রথম অর্থে অর্থাৎ আমাদের দিকে খেয়াল করুন অর্থে বলতেন।





রাসুল (সা.)-এর দয়া দৃষ্টি পাওয়ার আশায় তারা বলতেন ‘ইয়া রাসুলাল্লাহ রাইনা’। মুনাফিকরা দ্বিতীয় অর্থাৎ ‘হে আমাদের রাখাল’ অর্থে এই শব্দের ব্যবহার শুরু করল। তারা রাসুলকে (সা.) ‘রাইনা’ বলা শুরু করল। যখন এমন দুই রকম ব্যবহার শুরু হলো, তখন আল্লাহ তায়ালা সাহাবিদের স্পষ্টভাবে নিষেধ করে দিলেন, ‘তোমরা নবীজিকে রাইনা বলো না; বরং বলো, উনজুরনা। [সুরা বাকারা, আয়াত:১০৪]। দুটি শব্দের অর্থ একই হওয়া সত্ত্বেও একটির ব্যবহার নিষেধ করা হলো। নবীজির শানে দ্ব্যর্থবোধক শব্দ পরিত্যাগ করতে নির্দেশ দেওয়া হলো পবিত্র কোরআনে। আরও পড়ুন: যেভাবে বুঝবেন আপনার ওপর জাকাত ফরজ ইসলামের দুশমনরা যখন রাসুলকে (সা.) জঙ্গি এবং ইসলামকে





জঙ্গিবাদী বলে আখ্যায়িত করছে এবং তারা নিঃসন্দেহে নেতিবাচক অর্থেই করছে, তখন নবিপ্রেমীরা কখনো এ শব্দটিকে নবীজির ক্ষেত্রে প্রয়োগের দুঃসাহস করতে পারেন না। একমাত্র মুনাফিকরাই এমন সাহস করতে পারে। জঙ্গিবিমান নেতিবাচক অর্থে ব্যবহার হয় না; কিন্তু জঙ্গি মানুষ নেতিবাচক অর্থেই ব্যবহৃত হয়। ফারসি ও উর্দু ভাষায় ইতিবাচক-নেতিবাচক দুই রকম প্রয়োগ থাকলেও বাংলায় আজকাল এটাকে কখনোই ইতিবাচক অর্থে ব্যবহার করা হয় না। কাজেই নবী ও সাহাবিদের জঙ্গি বললে ইসলাম থেকেই খারিজ হয়ে যাওয়ার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে। ব্লাসফেমি আইন থাকলে এতদিনে এ ধরনের বক্তাদের ফাঁসিতে ঝুলতে হতো। ব্লাসফেমি আইন ছাড়াও সাধারণ আইনেও এসব বক্তাকে বিচার





করা যায়। বিশেষত যারা মুক্তিযোদ্ধাদের জঙ্গি বলার দুঃসাহস করে, তাদের ধর্মীয় আইন ছাড়াও দেশীয় আইনের আওতায় আনা উচিত। তা না হলে সমাজে বিভিন্ন স্পর্শকাতর শব্দের অপব্যবহারের ফলে দিন দিন বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির আশঙ্কা বৃদ্ধি পাবে। ভাষাতত্ত্বের একটি সাধারণ নিয়ম হচ্ছে এই যে, এক ভাষা থেকে আরেক ভাষায় কোনো শব্দ আমদানি হলে তা হুবহু আগের ভাষার মূল অর্থে সবসময় ব্যবহৃত হয় না; বরং কিছুটা পরিবর্তিত হয় অনেক সময়। একটি উদাহরণে বিষয়টি স্পষ্ট হবে। যেমন, দালাল শব্দটি বাংলায় মধ্যস্বত্বভোগী অর্থে ব্যবহৃত হয়। বাংলা একাডেমি ব্যবহারিক অভিধানে এ শব্দটির তিনটি অর্থ উল্লেখ করা হয়েছে। ১. কমিশনের বিনিময়ে যে ব্যক্তি ক্রেতা ও বিক্রেতাকে ক্রয়-বিক্রয়ে সাহায্য করে; ব্যবসা-বাণিজ্যে যে ব্যক্তি মধ্যস্থতা করে। ২. ক্রেতা বা মালপত্র সংগ্রহকারী এবং ৩.অসংগতভাবে পক্ষ সমর্থনকারী। এখানে





দেখতে পাচ্ছেন, দালাল শব্দটি বাংলা অভিধানে ভালো-মন্দ দুই অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু সমাজে এ শব্দটি কখনোই ইতিবাচক অর্থে ব্যবহার হয় না। এ শব্দটি আরবি দাল্লাল থেকে উদ্গত।দাল্লাল আরবি ভাষায় খুব সুন্দর একটি শব্দ। এর অর্থ প্রিয় মানুষকে সুন্দর কণ্ঠ দিয়ে আকৃষ্ট করা।দালালের কাজও থাকে সুন্দর কথায় ক্রেতাদের আকৃষ্ট করা। কিন্তু আরবি ভাষায় কোনো বক্র অর্থে নয়; বরং ভালো অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে। আরবরা প্রিয়তমাকে দাল্লাল নাম দিয়ে থাকে। মিসর ও ফিলিস্তিনে এই নামের বিখ্যাত মনীষী আছেন। দালাল আল-মাগরিবি ফিলিস্তিনের জাতীয় বীরাঙ্গনা। দালাল আব্দুল আজিজ মিসরের বিখ্যাত অভিনেত্রী মিসরের অপর বিখ্যাত অভিনেতা সামির গানিমের স্ত্রী। আরব বিশ্বে এমন অনেক বিখ্যাত মানুষের নাম রয়েছে দালাল বা দাল্লাল শব্দ দিয়ে। দালাল শব্দের মূল অর্থ অন্যকে আকৃষ্ট করা। ওয়ায়েজিনরা যেহেতু তাদের





সুন্দর ওয়াজ দ্বারা মানুষকে আকর্ষণ করেন, তাদের কি এখন এই নাম দেওয়া যাবে? আরও পড়ুন: জাকাতের পরিমাণ যেভাবে নির্ধারণ করবেন এমন অসংখ্য নজির দেওয়া যাবে, যেখানে শব্দের মূল উৎপত্তি ভালো হলেও শব্দটির ব্যবহার, প্রয়োগ ও প্রচলন ভিন্ন হওয়ার কারণে মূল অর্থের প্রতি লক্ষ করা হয় না। সহবাস শব্দটির মূল অর্থ একত্রে বসবাস করা, কিন্তু আপনি আপনার বন্ধুকে কি বলতে পারবেন, আসো আমরা সহবাস করি? এটা চরমভাবে শ্রুতিকটু ও অভদ্রোচিত রসিকতা বলে বিবেচিত হবে। এ বিষয়ে উসুলে ফিকহের একটি মূল নীতিও রয়েছে। কোনো শব্দের মূল অর্থকে বলা হয় হাকিকতে লুগাবিয়্যাহ, আর প্রচলিত অর্থকে বলা হয় হাকিকতে উরফিয়্যাহ। উসুলে ফিকহের প্রায় প্রতিটি





গ্রন্থে এ বিষয়টি স্পষ্ট করা হয়েছে যে, হাকিকতে লুগাবিয়্যাহ (আভিধানিক অর্থ) পরিত্যাগ করে হাকিকতে উরফিয়্যাহ (প্রচলিত অর্থ) গ্রহণ করতে হবে। তা ছাড়া যেভাবে জঙ্গি শব্দের পক্ষে সাফাই গাওয়া হয়েছে, সন্ত্রাস শব্দটির পক্ষেও সাফাই গাওয়া যায়। প্রচলন না দেখে শুধু অভিধান দেখে ফতোয়া দিলে এসব বিকৃত রুচির মানুষ রাসুলকে (সা.) সন্ত্রাসী বলতেও কুণ্ঠিত হবে না। কারণ, সন্ত্রাস শব্দের মূল এসেছে ত্রাস থেকে। বাংলা একাডেমি ব্যবহারিক অভিধানে এর অর্থ লেখা হয়েছে: যেকোনো উদ্দেশ্যে মানুষের মনে ভীতি সৃষ্টি করার প্রচেষ্টা। ‘সন্ত্রাসী’ শব্দের অর্থ লেখা হয়েছে: ‘যে বা যারা কোনো উদ্দেশ্য সাধনের জন্য শঙ্কা বা ভীতির সৃষ্টি করে’। এই বক্তারা বলবেন, রাসুল (সা.) কাফেরদের মনে ভীতি সৃষ্টি করেছেন। পবিত্র কুরআনে শত্রুদের মনে ত্রাস সৃষ্টির নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। [সুরা আনফাল, আয়াত: ৬০] কাজেই সাহাবিরা সবাই সন্ত্রাসী ছিলেন। নাউজুবিল্লাহ। এখানে ভুল কোথায়? স্পর্শকাতর একটি বিষয়ে পরিবেশ পরিস্থিতি ও প্রচলনের প্রতি লক্ষ না করেই





শুধু অভিধানের ওপর নির্ভর করে কোনো সিদ্ধান্ত দিতে যাওয়া। এটা কোনো একাডেমিক নীতি নয়। যাদের উসুল সম্পর্কে ধারণা আছে বা ভাষাতাত্ত্বিক জ্ঞান আছে, তারা এমন ভুল করবেন না। কথিত বক্তাদের পক্ষ থেকে একটি পাল্টা যুক্তি দেওয়া হচ্ছে এভাবে, জিহাদ শব্দের মূল ভালো হলেও এটিও নেতিবাচক অর্থে ব্যবহার হয় পশ্চিমা বিশ্বের সাধারণ সমাজে; তাই বলে কি এ শব্দ পরিত্যাগ করা হবে? জিহাদ শব্দ পরিত্যাগ করা না হলে জঙ্গি শব্দটিও পরিত্যাগ করা হবে না। মূলত ফারসিতে একটি প্রবাদ আছে: ‘নিম মুল্লা খতরায়ে ইমান..।’ অর্ধেক জ্ঞান ঈমানের জন্য আশঙ্কার। জিহাদ শব্দটি কোরআন ও হাদিসে ব্যবহৃত শব্দ। উসুলে ফিকহে এ ধরনের শব্দের শারঈ অর্থকে হাকিকতে শারইয়্যাহ





(শরিয়তের পারিভাষা) আখ্যায়িত করা হয়েছে। যখন হাকিকতে শারইয়্যার সঙ্গে হাকিকতে উরফিয়্যার সংঘর্ষ হবে, তখন নিঃসন্দেহে হাকিকতে শারইয়্যাহ গ্রহণ করতে হবে। জিহাদ ও জঙ্গি শব্দের পার্থক্য এখানেই। জঙ্গি শব্দ কোরআন-হাদিসের শব্দ নয়। এটি ফারসি থেকে উদ্গত। খোদ ফারসি ভাষায়ও এর নেতিবাচক ব্যবহার রয়েছে। বাংলা ভাষায় বর্তমান প্রচলন সন্ত্রাসী ও আতঙ্কবাদী অর্থে। অন্য কিছুর সঙ্গে যুক্ত হয়ে এলে কখনো হয়তো নেতিবাচকতা থাকে না, কিন্তু অন্য কোনো শব্দের সঙ্গে যুক্ত হয়ে না এলে এটি আতঙ্কবাদ ও সন্ত্রাসবাদের সমার্থক। এমন একটি শব্দ কোনোভাবেই রাসুল (সা.)-এর সুমহান পবিত্র সত্তার দিকে সম্পৃক্ত করা যায় না। যদি কেউ ভুলবশত এ শব্দের ব্যবহার করে থাকে,





তাহলে তাকে অবশ্যই তওবা করতে হবে। তা না হলে রাসুল (সা.)-এর শানে বেআদবির কারণে ঈমান ও ইসলাম থেকে খারিজ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা আমাদের সবাইকে হেফাজত করুন। আমিন।