আলোচিত খবর

পড়াশোনার কারণে শ্বশুরবাড়িতে ভাত বন্ধ হয়ে যাওয়া শিউলি চিকিৎসক হচ্ছেন!

পৃথিবীতে বসবাস করতে গিয়ে মানুষ নানা বাধা-বিপত্তির সম্মুখীন হয়।

জীবনে বেঁচে থাকার প্রতি পদে পদে মানুষকে বাধা বিঘ্নের সাথে সংগ্রাম

করে চলতে হয়। এজন্য মানুষ নানা ধরনের কাজ করে থাকে। কাজের সাফল্যের জন্য মানুষের ইচ্ছা শক্তির গুরুত্ব বেশি। এক কেজি আটার দাম তখন ১০ টাকা, আর একটা খাতার দামও ১০ টাকা। আটা কিনলে খাতা হয় না, আবার খাতা কিনলে না খেয়ে রাত কাটাতে হয়। তারপরও খাতাই কিনেছিলেন শিউলি। ভাতের অভাব থেকে মুক্তির আশায় স্কুলে পড়ার সময় মা–বাবা তাঁকে বিয়ে দিয়েছিলেন। শ্বশুরবাড়িতে ভাতের অভাব ছিল না, কিন্তু সেখানেও তাঁর কান্না থামেনি। বাড়ির বউকে আর পড়াতে চাননি তাঁরা। শিউলির জেদ, তিনি পড়বেন। স্বামীও পড়াবেন। এরপর বাড়িতে শিউলির ভাত বন্ধ হয়ে যায়। না খেয়েই কলেজে যান। প্রতিবাদ করায় স্বামীসহ শিউলিকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়। স্বামী সামান্য বেতনে একটি কোম্পানির কাজ করতেন। বাড়ি ভাড়া দিলে আর খাওয়ার কিছু থাকে না। এরই মধ্যে শিউলি মেডিকেল

কলেজে ভর্তির সুযোগ পান। পড়তে পড়তেই মা হয়েছেন। এসব করেই এবার তিনি বারিন্দ মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করেছেন। সব মিলে শিউলির জীবনটা সিনেমার গল্পের মতো। শেষ দৃশ্যে এসেও চোখের পানি মুছতে হয়। অল্প দিনের জন্য তাঁর বাবা মেয়ের এ সাফল্য দেখে যেতে পারেননি। এ কথা বলতে গিয়ে কেঁদে ফেললেন শিউলি। পুরো নাম শিউলি আক্তার। স্বামী রাশেদুর রহমান। তাঁরা এখন রাজশাহী নগরের মেহেরচণ্ডী মধ্যপাড়া এলাকায় একটি ভাড়া বাসায় থাকেন। শিউলির মা সাবিয়া বেগমও মেয়ের সঙ্গেই থাকেন। শিউলির বাবার বাড়ি রাজশাহীর চারঘাট উপজেলার মুক্তারপুর খলিফাপাড়া গ্রামে। সরদহ ট্রাফিক মোড়ে তাঁর বাবা জাহাঙ্গীর হোসেনের একটি চায়ের দোকান ছিল। এটিই ছিল শিউলিদের পরিবারের আয়ের একমাত্র উত্স। সেই চায়ের দোকানটিও একসময় পুড়িয়ে দেয় দুর্বৃত্তরা। তাঁর শিক্ষাজীবনের শুরুই হয়েছে যেন অবহেলার মধ্য দিয়ে। পড়ার জন্য এক শিক্ষকের বাসায় গিয়েছিলেন। সেখানে তাঁর মাকে একটি ভাঙা চেয়ারে বসতে দেওয়া হয়েছিল। অন্যদের বসানো হয়েছিল ভালো জায়গায়। তাঁর শিশু মনে এটি তখন দাগ কেটেছিল। তখন থেকেই তাঁর জেদ, যেকোনো মূল্যে পড়াশোনা চালিয়ে যাবেন। কিন্তু অভাবের সঙ্গে দৈনিক তাঁকে যুদ্ধ করতে হয়েছে। ভাঙা ঘরে বৃষ্টির রাতে ঘুমানো যেত না। না খেয়েও স্কুলে যেতে হয়েছে। পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণির বৃত্তির টাকা দিয়েই পড়ার খরচ চালাতে হয়েছে। এ অভাবের কারণেই নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় পদার্থবিজ্ঞান পরীক্ষার আগের দিন রাতে হঠাৎ তাঁর বিয়ে হয়ে গেল। এসএসসি পাস স্বামী তখন একটি বাল্ব কোম্পানিতে চাকরি করতেন। দশম শ্রেণিতে পড়ার সময় স্বামীর সেই চাকরিটাও চলে গেল। এসবের মধ্যেই ২০১১ সালে সরদহ সরকারি পাইলট উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষায় সব বিষয়ে শিউলি পেলেন জিপিএ-৫। রাজশাহী কলেজে ভর্তির সুযোগ পাওয়ার পরও যাতায়াত খরচের টাকার কথা ভেবে সেখান ভর্তি হননি। শ্বশুরবাড়ির কাছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় স্কুল ও কলেজে ভর্তি হলেন। তখন তাঁর স্বামী রাশেদুর রহমান বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষতে (বিএমডিএ) মাসিক দেড় হাজার টাকার একটি কাজ পান। এ সময় শ্বশুরবাড়ির লোকজনের বাধার মুখে শিউলির পড়াশোনা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। তাঁরা বাড়ির বউকে পড়াশোনা করতে দিতে চান না। পড়াশোনা বন্ধ করতে তাঁর ভাত বন্ধ করে দেওয়ার মতো নিষ্ঠুর আচরণও করেছে তাঁর পরিবারের লোকজন। স্বামীর পাশে বসেই শিউলি শোনাচ্ছিলেন তাঁর জীবনের এ নিষ্ঠুরতার গল্প। স্বামীও স্বীকার করলেন, স্ত্রীর পক্ষ নেওয়ায় সে সময় তাঁদের বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়। স্ত্রীকে নিয়ে ভাড়াবাড়িতে ওঠেন রাশেদুর। ২০১৩ সালের এইচএসসি পরীক্ষায় শিউলি আবারও সব বিষয়ে এ প্লাস পেলেন। ছোটবেলার স্বপ্ন ছিল মেডিকেলে পড়বেন। প্রথমবার হলো না। দ্বিতীয়বার অল্প নম্বরের জন্য বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তির সুযোগ হলো। এইচএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর স্থানীয় একটি পত্রিকায় খবর হয়েছিল ‘অর্থের অভাবে কি শিউলি ফুটবে না?’ খবর শুনে অনেকেই ছুটে গেলেন কিন্তু বিবাহিত মেয়ের কথা শুনে পরে কেউ সাড়া দেননি। শিউলি বলেন, এটা তাঁর জীবনের সবচেয়ে হতাশার সময়। তীরে এসে তরি ডুবে যাওয়ার মতো দশা। নিজেরা কিছুই করতে পারছেন না। স্বামীর বেতনটা শুধু দেড় হাজার থেকে বেড়ে ৩ হাজার ৬০০ টাকা হয়েছে। এমন সময় একদিন বারিন্দ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. শামসুদ্দিন শিউলির খবর নেওয়ার জন্য গাড়ি পাঠালেন। সব শুনে শামসুদ্দিনই তাঁকে বারিন্দ মেডিকেল কলেজে ভর্তির ব্যবস্থা করে দিলেন। শুধু ভর্তি না, শিউলির পড়াশোনার খরচের (প্রায় ৩০ লাখ টাকা) পুরো দায়িত্ব নিলেন তিনি। পড়াশোনার বাইরেও বাসার বাজার, টুকটাক দরকারি জিনিসপত্র নিয়মিত কিনে দিয়েছেন।

Related Articles

Back to top button